কালো কবিতাঃপর্যালোচনা

আমেরিকার সংস্কৃতি ও শিল্পচেতনায় 'ব্ল্যাক আর্ট মুভমেন্ট' একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
টাইম ম্যাগাজিনে এই আন্দোলন 'আফ্রিকান-আমেরিকান'সাহিত্যের ইতিহাসে একক বিতর্কিত আন্দোলন
হিসেবে বর্ণিত হয় যা কৃষ্ণাঙ্গদের নিজস্ব প্রকাশনী,ম্যাগাজিন,জার্নাল এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।
আমেরিকায় নিগ্রোদের ইতিহাস আনুমানিক প্রায় চারশো বছরের মতো।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় চুক্তির ভিত্তিতে গৃহভৃত্য আনার চল শুরু হয়।
চুক্তি মেনে এগোলে গৃহভৃত্যরা মুক্তি পেতেন এবং তারা নাগরিকত্ব নিয়ে নিজেরাও গৃহভৃত্য নিয়োগ করতে পারতেন।
১৬৪০ সালে জন পাঞ্চ নামে এক ভৃত্য পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, কোর্ট শক্ত হাতে রাশ ধরে এবং দাসত্ব প্রথা বৈধ করে।
তবে চুক্তিবদ্ধ ভৃত্য-পরিষেবা যে ক্রীতদাস প্রথার পূর্বসুরি, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
১৭৭৯ সালের পর থেকে জন্মসূত্রে আফ্রিকানরাই দাস হিসেবে গণ্য হতেন এবং পণ্য হিসেবেও।
সেনাতে কালোমানুষ যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ হয়।রাজনৈতিক চাপে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দাস ব্যবসার উচ্ছেদ হলেও,
বেআইনি ভাবে তা রমরমিয়ে চলছিল।এর উপর 'জিম ক্রো' আইন বলবৎ নিগ্রোদের মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
 
জিম ক্রো একটি কল্পিত নিগ্রো চরিত্র,যে হাস্যকর অসংগতি দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করত।
শেষ পর্যন্ত জিম ক্রো অশিক্ষিত, অনুৎপাদনকারী, অপেশাদার,নিগ্রো এইসব অনুষঙ্গের সমার্থক হয়ে যায়।
কৃষ্ণাঙ্গদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নিগার,ডার্কি,কুন বলা হত। ধীরে ধীরে তাদের মনোবল,আত্মবিশ্বাস,আত্মসম্মান ভেঙ্গে যায়।
শ্রম,লুন্ঠন,মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার,নারীদের ক্ষেতে যৌন অত্যাচার,বিনা পারিশ্রমিকে বাধ্যতামূলক শ্রমদান,
ভবিষ্যৎ শ্রমিকগোষ্ঠীর প্রয়োজনে বলপূর্বক অবৈধ গর্ভধারণ হত।
একজন মালিকের সামাজিক স্তর বিভাজন করতে গিয়ে দাসেদের স্থানাঙ্ক থাকত গবাদিপশুদেরও নীচে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মহিলা কবিদের কবিতা তুলে ধরা হয়েছে,
যেখানে তাদের ক্ষোভ,অসন্তোষ থেকে জন্ম নিয়েছে তীব্র প্রতিবাদী,প্রতিরোধী উচ্চারণ।
তারা রক্তের বিনিময়ে কবিতা উপহার দিয়েছেন।এই নিবন্ধে আংশিকভাবে নারীদের  হতাশা,দ্রোহ,বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বাস্তব অবস্থা আরো করুণ,নিষ্ঠুর। 
এইসব কবিদের শিল্পসৃষ্টি আমেরিকার অর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটি প্রামাণ্য দলিল।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিরা ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ, দাস ব্যবসায় উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর কবিরা লিঙ্গ ও বর্ণ বৈষম্য নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, নারীদের সমানাধিকার ও সমকামিতার সপক্ষে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন নির্ভয়ে।

‘আর ওরা যখন জঙ্গল কেটে ফেলতে থাকবে
তুমি আরও বৃক্ষরোপণ করতে থাকবে
শুরু করবে একেবারে গোড়া থেকে’
বইটির শেষ কবিতা অ্যালিস ওয়ালকারের ‘অত্যাচার’ এর এই শেষ তিনটি লাইন,যা দিয়ে বইটিও শেষ হচ্ছে,
যা হাল না ছেড়ে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার গল্প শোনায়।
জুন জর্ডনের কিছু কবিতাতে আমরা হতাশার আদল পেয়েছি। তিনি বলতেন,আমার সমগ্র বিশ্ব ছিল সাদা।
কালো মানুষরা ধর্তব্যের মধ্যে পড়তেন না,যেন তরুণীর প্রাণবন্ত কালো চুলে পাক ধরে তা গ্রাস করে নেওয়ার চেষ্টা।
বর্ণ,শ্রেণি,লিঙ্গবৈষম্য এর বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়ে গিয়েছেন।হাঁফিয়ে গেলে লিখেছেন,

‘সারি সারি হাজার হাজার বাড়িতে আগুন জ্বলছে
কোনো পক্ষই কাউকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে না
কারও জল নেই, কারও রুটি, কারও বন্দুক নেই
আন্তর্জাতিক টেলিভিশন আছে, অথচ খবর নেই

সৈন্যরা ঢুকে পড়ে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে
আমি দেখি আর অপেক্ষা করতে থাকি
অনেক দূরে আমি,অনেক দূরে
দেরি হয়ে গেছে
বড্ড দেরী হয়ে গেছে।' -১০ এপ্রিল,১৯৯৯

বইটিতে এরকম প্রতিবাদী মানুষদের কাব্যিক জবানবন্দি রয়েছে।
বি রিচার্ডস, জেন কর্তেস,নিকি জিওভান্নি,মায়া এঞ্জেলু সহ আরো অনেক কবির লেখা রয়েছে এতে।
শ্রী অশোক চক্রবর্তী মহাশয় সুনিপুণ ভাবে প্রত্যেকটি কবিতার অনুবাদ করেছেন।
অনুবাদের ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ।প্রতিটি কবিতার ভাব সুন্দর ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
 
বইটির আরেকটা চমকপ্রদ অংশ হল প্রচ্ছদ যা তৈরী করেছেন শ্রী সুদীপ্ত দত্ত
সাদা পটভূমির ওপর ফুটে ওঠা একটা কালো অবয়ব ও তাতে অজস্র ফুটো, যা ক্ষতের জানান দিচ্ছে।
তার ভেতর দিয়ে উঁকি মারছে গেরুয়া-লালচে মলাট, হয়ত ক্ষত গুলো জীবন্ত।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে Sparkbookcompany.com থেকে এবং পরিবেশন করছে ভিরাসত আর্ট পাবলিকেশন। 
বইটি আদতেই প্রতিবাদ,প্রতিরোধ, শ্বেতাঙ্গদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের গর্জে ওঠার পাণ্ডুলিপি। 
 বইটি পড়ার সময় পাঠক নিরাশ হবেননা এবং ব্লাক আর্ট মুভমেন্ট নিয়ে বিশদে জানতে চাইবেন এই ব্যাপারে আশাবাদী।
 
- অ।।পো